নিজস্ব প্রতিবেদক: লিবিয়ায় মানপাচারকারীদের গুলিতে ২৬ নিহত ও ১১ বাংলাদেশি আহতের ঘটনায় মানবপাচারকারীদের হোতা হাজী কামাল উদ্দিন এখন কারাগারে। তিনি মানবপাচার করেই কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। এই কামাল উদ্দিনকে গ্রামে সকলেই চিনত হাজী কামাল নামে। আগে ছিলেন রাজমিস্ত্রি। এ কাজের পাশাপাশি শুরু করেন আদম ব্যবসা। টাকা-পয়সা হওয়ার পর টাইলসের কনটাক্টর হিসেবে ব্যবসাও শুরু করেন। মূলত এটি ছিল তার মানবপাচারের জন্য লোকজন সংগ্রহের কৌশল মাত্র। সেই ব্যবসার আড়ালে চলত তার মানবপাচার ব্যবসা। তবে অল্প দিনেই টাকার পাহাড় গড়েন শুধু মানবপাচার করে। গত ১০ বছরে হাজী কামাল লিবিয়ায় ৪০০ লোককে পাচার করেছেন। যাদের কেউ আর পরবর্তীতে ফিরে আসেনি বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
হাজী কামালের ব্যাপারে অনুসন্ধান, তার পরিবার ও গ্রামবাসী সূত্রে জানা গেছে, সৌদি থেকে ফিরে মানবপাচারে জড়ান কুষ্টিয়ার কামাল। ডিগ্রি (পাস কোর্স) পরীক্ষায় ফেল করার পর বাড়ি ছেড়ে চলে যায় কুষ্টিয়া সদর উপজেলার খোর্দ আইলচারা গ্রামের কামাল উদ্দিন । এরপর ঢাকা থেকে সৌদি আরবে কাজ করতে যায়। সেখানে প্রায় দুই বছর রাজমিস্ত্রির কাজ করে সে দেশে ফিরে আসে। জড়িয়ে পড়ে মানবপাচারে। এ কাজের জন্য তার শুরু থেকেই কোনো ধরনের লাইসেন্স ছিল না। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত সে কাজ করত। তার নিজ এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার শতাধিক মানুষকে বিদেশে পাঠিয়েছে সে। এসব লোকজনের বেশির ভাগই লিবিয়ায় পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে।
কামালের বড় ভাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক লুৎফর রহমান বলেন, এইচএসসি পাসের পর কামাল রাজবাড়ীতে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়। ফেল করার পর ঢাকায় পালিয়ে যায়। সৌদি আরবে গিয়ে রাজমিস্ত্রি হিসেবে কাজ শুরু করে। দুই বছর পর ফিরে বিদেশে মানুষ পাঠানোর কাজে জড়িয়ে পড়ে। ঢাকায় টাইলস মিস্ত্রির কাজের পাশাপাশি বিদেশে মানুষ পাঠানোর কাজ করে। তিনি আরও বলেন, তার পজিশন খুবই সামান্য। তার কোনো লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান নেই। সে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করত।
কামালের বাড়িতে গিয়ে সরেজমিন দেখা গেছে, তার একতলা তিন কক্ষের একটি ছাদের বাড়ি। গ্রামে গেলে সে এখানেই থাকে। স্ত্রী ও এক সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় শাহজাদপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকত। বাড়িতে তার মাসহ ভাইয়েরা পৃথক বাড়িতে থাকেন। খোদ আইলচারা গ্রামের বাসিন্দারাদের দাবি, প্রায় ২০ বছর আগে সে গ্রাম থেকে ঢাকায় চলে যায়। এরপর থেকে নিজের গ্রামসহ আশপাশের কয়েক গ্রামের অন্তত ১০০ জনকে টাকার বিনিময়ে বিদেশে পাঠিয়েছে। বছরে তিন-চারবার বাড়িতে আসত। কয়েক দিন থাকার পর ঢাকায় চলে যেত।
এদিকে র্যাব জানায়, কামাল উদ্দিন ওরফে হাজী কামাল একজন টাইলস ব্যবসায়ী হলেও এর আড়ালে গত ১০ বছর ধরে সে অবৈধ পন্থায় মানবপাচার করে আসছিল। টাইলস নেওয়ার জন্য যেসব শ্রমিক তার প্রতিষ্ঠানে যেতেন তাদেরকে গল্প শোনাত লিবিয়া গেলে প্রচুর টাকা পাওয়া যায়। সেখানে টাইলস-শ্রমিকের অধিক চাহিদা।
লিবিয়ায় গেলে দিনে ৫-৬ হাজার করে টাকা আয়ের সুযোগও আছে। তবে সেখানে যেতে হলে বেশি টাকার প্রয়োজন নেই। মাত্র ৫ লাখ টাকা দিলেই হবে। তবে শর্ত হলো সেখানে গিয়ে ১ লাখ টাকা দিতে হবে। বাকি চার লাখ সেখানে গিয়ে পাঠালেও হবে। এভাবে ভালো আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে টাইলসের শ্রমিকদের হাজী কামাল লিবিয়ায় পাঠাত। একবার পাঠিয়েই তার কাজ শেষ। আর কখনই খোঁজও নিত না।
র্যাব আরও জানায়, হাজী কামাল গ্রামের সহজ-সরল লোকদের টার্গেট করত। যেসব লোক লিবিয়ায় যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে যেত তাদের আরও নানা প্রলোভন দেখিয়ে দ্রুত পাসপোর্ট করাত। এরপর সেই ব্যক্তি জমি, ভিটেমাটি বিক্রি করে অথবা ঋণ নিয়ে লিবিয়ায় যাওয়ার জন্য টাকা হাজী কামালের হাতে তুলে দিতেন। তবে হাজী কামাল তিন পদ্ধতিতে বিদেশে পাচার করত। প্রথমে সে লিবিয়া বা বিদেশ যেতে ইচ্ছুক নির্বাচন করত, তারপর তিনি তাদের লিবিয়ায় পাঠাত এবং সেখান থেকে ইউরোপ পাঠানোর লোভ দেখিয়ে বিদেশি দালালদের হাতে তুলে দিত এবং বিক্রি করত। এরপর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যেত না সেই ব্যক্তিদের। এই সংঘবদ্ধ চক্রটি বিদেশি চক্রের যোগসাজশে অবৈধভাবে বাংলাদেশি নাগরিকদের বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করত সে।
হাজী কামালকে জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবের কাছে সে স্বীকার করেছে, তার লোকজন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ত। এরপর অল্প টাকায় উন্নত দেশে যাওয়া যায় বলে প্রলোভন দেখাত। ভাগ্য পরিবর্তনে স্বপ্নে অনেকেই তাদের প্রস্তাবে সাড়াও দিত। ইচ্ছুকদের বিদেশে গমনের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকেট ক্রয়- প্রভৃতি কার্যাবলি তার লোকদের মাধ্যমেই সম্পন্ন করত। পরবর্তীতে তাদের এককালীন বা ধাপে ধাপে কিস্তি নির্ধারণ করে ইউরোপের পথে পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। এমন ফাঁদে ফেলে শুধু লিবিয়া নয়, সে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবৈধ প্রক্রিয়ায় শ্রমিকদের পাঠাত।
এদিকে এ ঘটনার পর লিবিয়ায় মানবপাচার ও ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যার ঘটনায় ৩৮ জনকে আসামি করে বাংলাদেশে মামলা হয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর পল্টন থানায় মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) পক্ষ থেকে দায়ের করা হয়। মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ও হত্যার অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।